Tuesday, September 24, 2013

উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান বাড়ানো জরুরি


সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৩, মঙ্গলবার : আশ্বিন ৯, ১৪২০
উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান বাড়ানো জরুরি
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
শিক্ষার উন্নয়ন হলেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব- এটা কোনো নতুন ধারণা নয়। উন্নত দেশগুলো এ ধারণার গুরুত্ব অনুধাবন করে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে নিয়মিত। তারা দেশের অন্য অনেক খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এ উদ্দেশ্যে তারা শিক্ষাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবমুক্ত রাখতে পারছে। শিক্ষার গুণগত মানের ব্যাপারে উন্নত দেশগুলো কখনোই কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন করে না। এ কারণেই উন্নত দেশগুলো আরও উন্নত হয়েছে। অনেক দেশ শিক্ষা খাতের মানোন্নয়নের জন্য যেমন রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ বেশি করে, ঠিক তেমনি তারা এ খাত থেকে জাতীয়ভাবে আয়ও করে অনেক বেশি। শিক্ষায় বিনিয়োগ করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে অনেক দেশ। এরকম একটি দেশ হল নিউজিল্যান্ড। নিউজিল্যান্ডে শিক্ষাকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ওই দেশটি গুণগত শিক্ষা রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। সে দেশের রফতানি তালিকার সেরা পাঁচের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা। নিউজিল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আকৃষ্ট হয়ে জাপান, চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করতে সে দেশে যায়। এমনকি কানাডা ও ইউরোপের অনেক দেশ থেকেও ছেলেমেয়েরা নিউজিল্যান্ডে পড়তে যায়।
নিউজিল্যান্ডসহ উন্নত দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টুডেন্টস অ্যাডভাইজররা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ায় শুধু বিদেশী ছাত্রছাত্রী সংগ্রহের জন্য। একবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ কলেজ অব এডুকেশনের এক অনুষ্ঠানে আমার পাশে বসেছিলেন ওই কলেজের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাডভাইজার লিজা ওয়াইজউড। অনেকদিন পর তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানালেন, তাদের কলেজ থেকে প্রতিবছর নির্দিষ্ট একটি সময়ে বিদেশী শিক্ষার্থী সংগ্রহের জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাডভাইজার হিসেবে তাকে বিভিন্ন দেশে যেতে হয়। এরই অংশ হিসেবে তিনি কানাডা গিয়েছিলেন। পরে হয়তো তাকে আবার অন্য কোনো দেশে যেতে হতে পারে। উন্নত দেশগুলোর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিই এভাবে নিজের দেশের শিক্ষার গুণগত মান অন্য দেশের কাছে তুলে ধরার মাধ্যমে বিদেশী শিক্ষার্থী সংগ্রহে বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ায়। এটা তাদের প্রতিষ্ঠানের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আয় বাড়ানোরও একটা উপায়। এটা তারা করতে পারছে কঠোরভাবে শিক্ষার আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে তাদের সরকার যথেষ্ট শক্ত ভূমিকা পালন করে।
বিদেশী অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সুযোগের বিষয়টি উল্লেখ করে দেশের সেরা দৈনিকগুলোতে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতে দেখা যায়। বিশেষ করে প্রতিবছর এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর এ ধরনের বিজ্ঞাপনের হার বেড়ে যায়। এইচএসসি পাস আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার কথা প্রচার করা হয় এসব বিজ্ঞাপনে। এমনকি তাদের শিক্ষার আন্তর্জাতিক মানের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়। কয়েকদিন আগে দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকায় এমন এক বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে, যার ডিগ্রি নাকি বিশ্বে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে ১২ নম্বরে রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে নিরাপদ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগের অভাবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী প্রতিবছর দেশ ছেড়ে চলে যায়। যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে যায়, তাদের খুব সামান্য অংশই দেশে ফেরত আসে। অধিকাংশই বিদেশে পড়ে থাকে নিরাপদ ও উন্নত জীবনের টানে। এ প্রবণতাকে মেধাবীদের দেশত্যাগ বলা যেতে পারে।
এ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন হতে পারে, আমাদের দেশের শিক্ষার অবস্থা কী? আমরা কেন আমাদের শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারছি না? কেন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশী শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশে আসতে আগ্রহ অনুভব করে না? আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ছে? তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটি আশার খবরও রয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরো বিজনেস অ্যাসেম্বলির এক জরিপে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এ খবরটা আমাদের অনেকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে সন্দেহ নেই। আমরা রুয়েটকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু এককালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি অর্জনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করে নিতে পারছে না? আমরা কি পারি না আমাদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে অন্তত দেশীয় র‌্যাংকিংয়ের ব্যবস্থা করতে?
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশে অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও আজ এগুলোর অধিকাংশই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পড়ে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দেয়ার সিঁড়ি থেকে ছিটকে পড়ছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে নানামুখী অস্থিরতা। আমাদের আক্ষেপ, বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে শিক্ষকদের আমরণ অনশন ও অবস্থান কর্মসূচির কারণে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার খবরও পত্রপত্রিকায় দেখতে হচ্ছে। এটা কি আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনায় চরম দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি নয়? অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পরিবর্তে সহকর্মীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে ভিসিকে অফিস করতে দেখা গেছে কয়েক সপ্তাহ আগে। ভেতরে ভেতরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও অস্থিরতা বিরাজ করছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বিবদমান গ্রপের পরস্পরবিরোধী অবস্থান এবং তাদের মধ্যে সশস্ত্র মহড়া সংঘটিত হতে দেখা যায় প্রায়ই। এসব পরিস্থিতি একদিকে শিক্ষার মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন সৃষ্টি করে চলেছে, অন্যদিকে এসব কর্মকাণ্ড সবার জন্য চরম উদ্বেগের ব্যাপারও বটে।
আমাদের না বলে উপায় নেই, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক বিরাট অংশ বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত। তাদের অনেককেই কখনও প্রোভিসিবিরোধী আন্দোলনে, কখনও অন্য কোনো ইস্যুতে প্রায়ই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপদে পড়ালেখার পরিবেশ থাকে না। মাঝে মাঝে ছাত্রদের বিভিন্ন আন্দোলনের কারণেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটে।
উচ্চশিক্ষা মানেই গবেষণানির্ভর পড়ালেখা। কিন্তু দেশের কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করার যথেষ্ট সুযোগ নেই। ফলে উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মান বাড়ছে না। এর অন্যতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থসংকট। হতাশার বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশী শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে আয় বাড়ানোর দিকে তেমন একটা মনোযোগ দিতে পারছে না। তারা সরকারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আয় বাড়াতে বিকল্প পথের অনুসন্ধানও খুব একটা করে না। আবার রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও শিক্ষায় গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করতে দেখা যায় না। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেককেই আফসোস করতে শোনা যায় প্রায়ই। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় না। এভাবে কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে কখনও?
শিক্ষার মান উন্নয়ন বলতে আমাদের চোখের সামনে কেবল ভেসে ওঠে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের বিপুল হারের কথা। অস্বীকার করার উপায় নেই, এ দুটি পরীক্ষা দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা হওয়ায় এগুলোর দিকে সবার নজর থাকে বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ দুটি পরীক্ষাতেই পাসের হার বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর আমরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হতে দেখে পুলকিত হই। কিন্তু আমরা কি ভাবছি, শিক্ষার্থীরা জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি পাবলিক পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফল করলেও তাদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ নির্বিঘ্ন করা যাচ্ছে না কেন? আজ যারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করে বের হচ্ছে, তাদের একটা অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য একসময় বিদেশে পাড়ি জমাবে সন্দেহ নেই। আর বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পড়ে থাকবে দেশে। যারা থাকবে দেশে তাদের অনেকের উচ্চশিক্ষার জীবনে নেমে আসবে দুঃসহ সেশনজট। এছাড়া বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তাহীন পরিবেশ তো রয়েছেই। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তির পথ কী?
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

Thursday, September 12, 2013

শিক্ষা আইন ২০১৩ : কয়েকটি সুপারিশ



ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৩, ২৮ ভাদ্র ১৪২০ এবং ০৫ জিলক্বদ ১৪৩৪
(উপ-সম্পাদকীয়)
শিক্ষা আইন ২০১৩ : কয়েকটি সুপারিশ
মো. মুজিবুর রহমান
২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে খসড়া আকারে প্রণয়ন করা হয়েছে শিক্ষা আইন, ২০১৩এ আইন নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। আলোচনা হচ্ছে এ কারণে যে, বাংলাদেশে এর আগে ১৯৯০ সালের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন ছাড়া দেশে অন্য কোনো শিক্ষা আইন নেই। অন্যদিকে সমালোচনা হচ্ছে বিশেষ করে শিক্ষা আইনের 'তফসিল-: অপরাধ ও শাস্তি' অংশে বর্ণিত শাস্তির প্রকৃতি নিয়ে। তবে শিক্ষা আইনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কয়েকটি সুপারিশ এখানে তুলে ধরা হলো
. শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর) শিক্ষায় অনার্স কোর্স পরিচালনা করে আসছে। ঢাকা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজেও শিক্ষায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে অনেক আগেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আরও কয়েকটি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষায় অনার্স কোর্স চালুর বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু এ কোর্সটিকে অন্য সাধারণ কোর্সের মতো বিবেচনা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালনা করা উচিত নয়। কারণ সাধারণ কোর্স এবং প্রশিক্ষণ কোর্সের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত অনেক মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। এ কারণে শিক্ষা বিষয়কে স্বাধীন কোর্স হিসেবে পরিচালনা করতে হলে দরকার শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Education) স্থাপন করা। অন্য অনেক দেশেই শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। লন্ডনে রয়েছে ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন। সিঙ্গাপুরে আছে National Institute of Education (NIE)জাপানে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাংলাদেশেও শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়টি শিক্ষা আইনে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে দেশের সরকারি ও বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসা যাবে। এছাড়া প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং শিক্ষা নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করার সুযোগও সৃষ্টি হবে। প্রসঙ্গত, দেশের সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো শিক্ষা বিষয়ের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়ার কারণে এসব কলেজের নাম পরিবর্তন করে 'কলেজ অব এডুকেশন' করা যেতে পারে।
. এডুকেশন বোর্ড রিক্রুটমেন্টস অথরিটি (ইবিআরএ) গঠন : বর্তমানে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে আলাদাভাবে জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া সরকার প্রয়োজনমতো শিক্ষা ক্যাডার থেকে শিক্ষকদের প্রেষণে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে বদলি করে থাকে। কিন্তু শিক্ষা বোর্ডের নিজস্ব উদ্যোগে একবার কেউ বোর্ডে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তিনি অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত ওই একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার সুযোগ পেয়ে থাকেনফলে একদিকে ওই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নতুন নতুন পরিস্থিতিতে কাজ করার সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে বহু বছর একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। কেউ কেউ বেপরোয়াভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যান। এ পরিস্থিতির অবসানের লক্ষ্যে সব শিক্ষা বোর্ডে জনবল নিয়োগের জন্য শিক্ষা আইনের আওতায় একটি অভিন্ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা দরকার।
. স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ (এলইএ) গঠন : বর্তমানে আমাদের স্কুলপর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য কোনো স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ নেই। অথচ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আইনের মাধ্যমে গঠিত স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ থাকা জরুরি। ইংল্যান্ডে স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ রয়েছে। সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইংল্যান্ডে শিক্ষা আইন, ১৯০২ অনুযায়ী প্রথম Local Education Authority (LEA) গঠন করা হয়। এলইএ তার অধিক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। বর্তমানে ইংল্যান্ডে ১৫২টি এবং ওয়েলসে ২২টি এলইএ রয়েছে। এসব এলইএ'র কার্যকর ভূমিকায় ইংল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ আন্তর্জাতিকভাবে শীর্ষ গুণগত মানসম্পন্ন হয়েছে। আমাদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য স্কুল ম্যানেজিং কমিটি (এসএমসি) প্রচলিত রয়েছে। এসএমসির দক্ষতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এ অবস্থায় স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ভেঙে স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ বা Local Education Authority (LEA) গঠন করা যেতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের স্বার্থেই বাংলাদেশকে এলইএ গঠনের বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।
. আঞ্চলিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষ (আরইএ) গঠন : এখানে প্রস্তাবিত স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠনের পাশাপাশি আঞ্চলিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষ বা Regional Education Authority (REA) গঠন করার বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। বর্তমানে দেশে যে কয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার আঞ্চলিক অফিস রয়েছে সেগুলো ভেঙে আঞ্চলিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। অভিযোগ রয়েছে, আমাদের আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস, জেলা শিক্ষা অফিস এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে খবরদারিমূলকভাবে অধীনস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। ফলে সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের সুসম্পর্কের অভাব দেখা যায়। দেশে যতই আইন থাকুক না কেন, এভাবে শিক্ষার উন্নয়ন হতে পারে না।
শিক্ষা প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও আর্থিক বিষয়াদি ছাড়া অন্যান্য বিষয় যেমনছুটির অনুমোদন (বিদেশ গমনের অনুমতি ব্যতীত), বদলী ও উচ্চশিক্ষার বিষয়গুলো আরইএ'র হাতে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে একই অঞ্চলে বদলির এখতিয়ার আরইএ'র হাতে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বদলী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের হাতে এবং শুধু উচ্চতর পদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের বদলির ক্ষমতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে রাখা যেতে পারে।
লেখক :সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com