Saturday, April 6, 2013

শিক্ষাব্যবস্থা থাকুক রাজনৈতিক কর্মসূচিমুক্ত



ঢাকা, শনিবার, এপ্রিল ৬, ২০১৩, চৈত্র ২৩, ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
শিক্ষাব্যবস্থা থাকুক রাজনৈতিক কর্মসূচিমুক্ত

মো. মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন কিছু অদ্ভুত ও অভাবনীয় ঘটনা ঘটে চলেছে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এক কথায় চলমান পরিস্থিতি শিক্ষার জন্য সৃষ্টি করেছে চরম সংকটজনক অধ্যায়। রাজনীতির মাঠে কী ঘটবে, রাজনৈতিক দলগুলো কী কী কর্মসূচি দেবে ও পালন করবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও আলাপ-আলোচনার অধিকার রাজনীতিকদের হাতে থাকলেও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনও রয়েছে। আমরা দেখছি, এ বছরের শুরু থেকেই দেশে যে ধরনের অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এক রকম ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতা শিক্ষাকে গভীর সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দেশের উন্নয়নের বিষয়টি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করলেও শিক্ষাকে উপেক্ষা করে কোনো দেশই উন্নতি করতে পারে না। যেকোনো ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলে শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন রাখতে হবে নির্বিঘ্ন। বর্তমানে যারা শিক্ষার্থী, একসময় তাদের হাতেই অর্পিত হবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে হলেও শিক্ষার্থীদের জন্য সুশিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা জরুরি। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা কি নিজেদের তেমনভাবে উপযুক্ত শিক্ষার্থী ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছে? বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন এখন অনেক দিক থেকে অনিরাপদ ও বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে। এবার যেন শুরু হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিস্ময়ের ব্যাপার, স্কুল শিক্ষাবর্ষের তিন মাস কেটে গেলেও এখনো কোনো স্কুলেই নিয়মিত পড়ালেখা শুরু হয়নি বলে গণমাধ্যমে খবর রয়েছে। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক হিসাবে দেখানো হয়েছে, গত তিন মাসে মাত্র ২০-২৫ দিন স্কুল খোলা ছিল। তাও ক্লাস হয়েছে ঢিলেঢালাভাবে। এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থাকায় স্বাভাবিকভাবেই অনেক স্কুল বন্ধ ছিল।
অন্যদিকে দেখা যায়, রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে বহু স্কুল থাকছে দিনের পর দিন বন্ধ। শুধু সরকারি নিয়ম রক্ষার জন্য যেসব স্কুল খোলা থাকছে, সেখানেও ক্লাস হচ্ছে না নিয়মিত; শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতার কারণে স্কুলে আসতে পারছে না। অনেক শিক্ষক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে আসছেন শুধু চাকরি বাঁচানোর জন্য। অনিয়মিতভাবে স্কুলে আসার কারণে শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলবিমুখ হয়ে পড়েছে অনেকটাই। এমনকি নিষিদ্ধ কোচিং সেন্টারগুলোয়ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। তারা পড়ালেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শিশুদের শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠান কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীরাও হরতালসহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে ছোটবেলা থেকেই। বহু কিন্ডারগার্টেন স্কুল এখন সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয়ও খোলা রাখতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ফলে ছুটির দিনে কেন স্কুল খোলা থাকছে এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়া যাচ্ছে না ছোট শিশুদের। শিশুরা জানে ও বিশ্বাস করে, ছুটির দিন মানেই আনন্দ-উল্লাস আর ঘুরে বেড়ানো। অথচ তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে বাস্তব সত্যের দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব কীভাবে নিরসন করা যাবে? এসব দিক এখন শিশুদের মনে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। এগুলো উদ্বেগের বিষয়।
সরকার ২০১৩ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তরে প্রবর্তন করেছে নতুন শিক্ষাক্রম। এ শিক্ষাক্রম সম্পর্কে শিক্ষকদের ধারণাও অপেক্ষাকৃত কম থাকায় নবপ্রবর্তিত শিক্ষাক্রমের আওতায় কীভাবে নতুন নতুন বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের পড়াতে হবে তা শিক্ষকদের জানা জরুরি ছিল। কারণ যে শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে পাঠদান করবেন, তারা যদি না জানেন, কীভাবে পড়াতে হবে তাহলে শিক্ষার্থীদের শেখাবেন কী? নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা অর্জনে দরকার ছিল স্কুলগুলো নিয়মিতভাবে খোলা রাখা। অথচ স্কুলকার্যক্রম বিঘ্নের মুখে পড়ায় শিক্ষকরাও নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে রয়েছেন অন্ধকারে। দেশজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে স্কুলে শিক্ষাদান কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় নতুন শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নও এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় আমরা কীভাবে আশা করব আমাদের শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন ঘটবে? দেশে যতই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করুক না কেন, একসময় শিক্ষাবর্ষ শেষ হবে এবং শিক্ষার্থীরাও স্কুলের নির্ধারিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে আর পাসও করবে; কিন্তু পরীক্ষায় পাস করলেই কি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হয়?
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বিঘ্ন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। হরতাল থাকায় শিক্ষা বোর্ডগুলো এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে অনেকবার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও নির্ধারিত পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছে। এসব নিয়ে অভিভাবকরা ছিলেন উদ্বেগ। পরীক্ষার্থীরা তো চরম দুশ্চিন্তা নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করেছে। পরীক্ষার রুটিন অনুযায়ী তারা যে বিষয়ের প্রস্তুতি নিয়েছে, পরে দেখা গেছে ওই বিষয়ের পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে তাদের প্রস্তুতিতে ঘটানো হয়েছে বিঘ্ন, তারা মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতায় ভুগেছে। শিক্ষার্থীদের এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য দায়ী কে? কেন শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা যাচ্ছে না?
এবার এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। পরীক্ষা ঠিকমতো আরম্ভ হতে না হতেই শুরু হয়েছে সংঘাতময় পরিস্থিতির। এপ্রিলজুড়েই বিভিন্ন ধরনের পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচির খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে চলমান এইচএসসি পরীক্ষাটিও যে বিঘ্নের মুখে পড়বে— এমন আশঙ্কা অমূলক নয় মোটেই। এ নিয়ে পরীক্ষার্থীরা চরম উদ্বেগ ও উকণ্ঠায় রয়েছে। অভিভাবকরাও অতিবাহিত করছেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সময়।
এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার রুটিন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা শেষ করতে পারবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়। প্রশ্ন জাগে, পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে নাকি নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে কি হবে না— সেটা নিয়ে চিন্তান্বিত থাকবে? এ ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে তারা ভালোভাবে পরীক্ষা দেবে কীভাবে? এখন দেখা যায়, দেশে বিরাজিত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের শিক্ষার জন্য চরম বেদনাদায়ক ও উদ্বেগজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুঃখের ব্যাপার, এসব দিক থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত।
উন্নত দেশের সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য, আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রভাবমুক্ত রাখতে পারছি না, তারা পারছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা নেতিবাচক রাজনীতির চর্চা দেখছে শিক্ষার্থী অবস্থায়ই। তারা সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের তৈরি করার সুযোগ পাচ্ছে না। উন্নত দেশে সংঘাতময় রাজনীতির মহড়া দেখা যায় না সচরাচর। অথচ আমাদের শিক্ষার্থীরা দেখছে, রাজনীতির নামে রাজপথে চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাংচুর, সংঘাত ও সংঘর্ষ। দেখা যায়, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়ে হামলে পড়ে প্রতিপক্ষের ওপর। এ অবস্থায় ভূলুণ্ঠিত হয় মানবিক গুণাবলি। এসব সুশিক্ষার লক্ষণ নয় কিছুতেই। প্রশ্ন হলো, এখন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কী করবে?
লেখক : সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com 

No comments:

Post a Comment