এপ্রিল ১৮, ২০১৩, বৃহস্পতিবার
: বৈশাখ ৫, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
ধ্বংসের কাছাকাছি শিক্ষা
মোঃ মু জি বু র র হ মা
ন
কোন জাতি যদি নিজেদের সংকট নিরসনের সহজ পথ খুঁজে না পায়, তাহলে বুঝে নিতে হবে সে জাতির শিক্ষার মধ্যে সমস্যা রয়েছে। দীর্ঘদিন যদি কোন দেশে বিশেষ কোন সমস্যা বিরাজ করে, তাহলেও ধরে নিতে হবে সমস্যাটা শিক্ষার মধ্যেই নিহিত। কারণ শিক্ষাই তো একমাত্র শক্তি, যার মাধ্যমে সাধারণ থেকে জটিল ও জটিলতর সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলো কিন্তু জাতীয় সংকটকালে শিক্ষার শক্তি প্রয়োগ করে সেগুলোর সমাধান খুঁজে বের করছে ঠিকই। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্নতর পরিস্থিতি। এখানে এখন পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানে শিক্ষা বোধ করি তেমন কোন কাজে আসছে না। বাস্তব অবস্থা দেখে মনে হয়, এ দেশে শিক্ষা নিজেই যেন ধ্বংসের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে স্থবির হয়ে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থায় গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের পত্রপত্রিকাগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বহু লেখা, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করে যাচ্ছে নিয়মিত। দেশের বিশিষ্টজনরাও গুরুত্ব দিচ্ছেন শিক্ষাকে রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে রাখার জন্য। পরীক্ষা চলাকালে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি না দেয়ার জন্যও আহ্বান জানানো হয়েছিল বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি।
কোন জাতি যদি নিজেদের সংকট নিরসনের সহজ পথ খুঁজে না পায়, তাহলে বুঝে নিতে হবে সে জাতির শিক্ষার মধ্যে সমস্যা রয়েছে। দীর্ঘদিন যদি কোন দেশে বিশেষ কোন সমস্যা বিরাজ করে, তাহলেও ধরে নিতে হবে সমস্যাটা শিক্ষার মধ্যেই নিহিত। কারণ শিক্ষাই তো একমাত্র শক্তি, যার মাধ্যমে সাধারণ থেকে জটিল ও জটিলতর সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলো কিন্তু জাতীয় সংকটকালে শিক্ষার শক্তি প্রয়োগ করে সেগুলোর সমাধান খুঁজে বের করছে ঠিকই। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্নতর পরিস্থিতি। এখানে এখন পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানে শিক্ষা বোধ করি তেমন কোন কাজে আসছে না। বাস্তব অবস্থা দেখে মনে হয়, এ দেশে শিক্ষা নিজেই যেন ধ্বংসের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে স্থবির হয়ে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থায় গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের পত্রপত্রিকাগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বহু লেখা, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করে যাচ্ছে নিয়মিত। দেশের বিশিষ্টজনরাও গুরুত্ব দিচ্ছেন শিক্ষাকে রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে রাখার জন্য। পরীক্ষা চলাকালে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি না দেয়ার জন্যও আহ্বান জানানো হয়েছিল বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি।
দেশের ছাত্রছাত্রীরা যদি
নিরাপদ ও উন্নত পরিবেশে সুশিক্ষা লাভের সুযোগ না পায়, তাহলেও সে জাতির দুর্ভোগের শেষ
থাকে না। সুনাগরিক তৈরি করা জাতীয় শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও জাতীয়ভাবে তা অর্জনে
বিঘ্ন ঘটলে এক সময় রাষ্ট্রকে তার চড়া মাশুল দিতে হয়। ধারণা করি, আমাদের দেশে শিক্ষার
অন্তর্নিহিত শক্তি হয়তো এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে সেটা আর রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানে কার্যকর
ভূমিকা রাখতে পারছে না। এমনকি প্রচলিত শিক্ষা পারছে না নাগরিক সমস্যার সমাধান করতে।
কারণ দীর্ঘদিনেও যখন রাজনৈতিক অঙ্গনে একই ধরনের সহিংস পরিস্থিতি বিরাজ করতে দেখা যায়,
তখন আমরা কী করে বলব আমাদের মধ্যে সুশিক্ষার ঘাটতি নেই? বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা স্বাভাবিকভাবেই
শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমাদের সন্তানরা নিরাপদে শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবে
কিনা সেটাই আমাদের ভাবনার মূল বিষয়।
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি,
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের উত্তপ্ত পরিস্থিতির প্রভাব সঞ্চারিত হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে। শুধু
নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ বিপর্যস্ত। স্পষ্টতই
বোঝা যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এ ধরনের অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি
পাচ্ছে না সহসা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রায় প্রতিদিনই
কোন না কোন কর্মসূচির কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে পড়ালেখা, বন্ধ থাকছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,
পিছিয়ে যাচ্ছে নির্ধারিত পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বেড়ে যাচ্ছে কোর্সের ব্যাপ্তি,
দেখা দিচ্ছে সেশনজট, আর দুশ্চিন্তা-দুর্ভোগ বাড়ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। আমাদের
আশংকা, হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্কুলেও এক সময় সৃষ্টি হবে সেশনজটের। কারণ স্কুলগুলোয়
এখন দিনের পর দিন ক্লাস হচ্ছে না। হরতাল ও রাজনৈতিক কর্মসূচির ফাঁদে পড়ে লাগাতার বন্ধ
থাকায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। হরতালের ফাঁকে ফাঁকে যে কয়দিন
স্কুল খোলা থাকে (হরতালের মধ্যে কিছু স্কুল খোলা থাকলেও ক্লাস হয় না) সেসব দিনেও শিক্ষার্থীরা
ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যেতে চায় না। স্কুলে পড়ালেখা না হওয়ায় বইয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের
সংযোগ কমে গেছে। ফলে তারা অলস সময় কাটাচ্ছে। বাস্তবত, এখন শিক্ষকদেরও তেমন কোন কাজ
নেই। অথচ শিক্ষাবর্ষের প্রায় অর্ধেক সময় পার হতে চলল। স্কুলগুলোয় নিয়মিত পড়ালেখা আরম্ভই
হয়নি। শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীনে পাবলিক পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে বারবার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধীনে পরিচালিত বিভিন্ন পরীক্ষাও পিছিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে চলমান এইচএসসির দুটো বিষয়ের
পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। আশংকা রয়েছে, রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলোও
বিঘ্নিত হতে পারে। একের পর এক হরতাল ও সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা
এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন থেকে যায়, এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে শিক্ষার
অন্তর্নিহিত শক্তি আমাদের মুক্তি দিতে পারছে না কেন?
শিক্ষা কার্যক্রম সরকার
পরিচালনা করলেও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। এমনকি পরীক্ষার্থীদের
পরীক্ষা কেন্দ্রে নির্বিঘ্নে যাতায়াতের বিষয়টিও কাউকে ভাবিয়ে তুলতে পারছে বলে মনে হয়
না। গত ১২ এপ্রিল দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের
লিখিত পরীক্ষা। ওই দিন শুধু টাঙ্গাইল জেলায় কয়েক হাজার প্রার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ
করতে পারেননি বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, পরীক্ষার আগের
দিন বৃহস্পতিবার টানা কয়েক দিনের হরতাল শেষ হওয়ার পর হাজার হাজার গাড়ি একসঙ্গে রাস্তায়
নেমে পড়ে। তখন রাত হলেও মানুষ হয়ে পড়ে কর্মব্যস্ত। ফলে দেশের অনেক জায়গায় দেখা দেয়
তীব্র যানজট। অনেক স্থানে কিছু গাড়ি বিকল হয়ে পড়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড়
নেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কিছু চালকের আইন না মেনে গাড়ি চালানোর প্রবণতা। টাঙ্গাইলের
মহাসড়কেও বৃহস্পতিবার রাত থেকেই যানজট দেখা দেয়। পরীক্ষার দিন যানজট আরও বেড়ে যাওয়ায়
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পরীক্ষার্থীরা এক সময় গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেঁটেই পরীক্ষার কেন্দ্রের উদ্দেশে
রওনা দেন। আর যাদের পরীক্ষা কেন্দ্র দূরে ছিল তাদের বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায়
উপস্থিত হতে পারেননি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা শুধু যাতায়াতের দুর্ভোগের কারণে পরীক্ষায়
অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন না তাদের বিষয়টি কীভাবে দেখা হবে? তারা যে ক্ষতির মুখোমুখি
হলেন সেটা পূরণ হবে কীভাবে? মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকেই বা তাদের মুক্তি দেবে কে? পরীক্ষার্থীদের
নির্বিঘ্নে যাতায়াতের ব্যবস্থা কেন করা গেল না? এর জন্য দায়ী কে?
যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে
নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু রাজনৈতিক
কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে যদি দেশজুড়ে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, বিপর্যস্ত হয় শিক্ষা
কার্যক্রম, বিঘ্নের মুখে পড়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখা, তাহলে সাধারণ মানুষের করণীয় তেমন
কিছুই থাকে না। আমাদের উচিত ছিল, শিক্ষার্থীরা যাতে নির্বঘ্নে পড়ালেখা করতে পারে, পরীক্ষার্থীরা
যাতে নিরাপদে এবং সময়মতো পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে পারে তার সুব্যবস্থা করা। কিন্তু
বাস্তবে দেখা গেল, ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিক সংকটের চাপে পড়ে পড়ালেখাবিমুখ হয়ে পড়ছে,
পরীক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে নিজ দায়িত্বে পরীক্ষার কেন্দ্রে যাচ্ছে; যদিও অনেক পরীক্ষার্থী
পরীক্ষার কেন্দ্রেও যেতে পারছেন না। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা
করছি কী?
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে অনেক স্থানে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের
প্রাণহানিরও খবর পাওয়া গেছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা যেমন উদ্বিগ্ন হই, তেমনি শিক্ষার্থীরাও
আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এমনকি পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচারিত সংঘাত ও সংঘর্ষের ছবি
দেখে শিশুদের মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার প্রবল আশংকা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, এ
ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া আমাদের কারও জন্যই শুভ নয়।
শেষ করার আগে বলতে হয়,
শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অনেক সাফল্যজনক অর্জন রয়েছে, যেগুলোর ধারাবাহিকতা
বজায় রাখা অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ২০১৩ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তরে নবপ্রবর্তিত শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় সৃষ্টি
হয়েছে। কারণ যে শিক্ষাক্রমের প্রয়োগ ভালোভাবে আরম্ভই হতে পারল না, সেটার কার্যকারিতা
যাচাই করা হবে কীভাবে? শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যদি অলস সময় কাটায় তাহলে কাঁড়ি কাঁড়ি
টাকা খরচ করে শিক্ষাক্রম আধুনিকায়ন করে কার্যত আমাদের কী লাভ হল?
মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স
ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com