Thursday, April 18, 2013

ধ্বংসের কাছাকাছি শিক্ষা



এপ্রিল ১৮, ২০১৩, বৃহস্পতিবার : বৈশাখ ৫, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
ধ্বংসের কাছাকাছি শিক্ষা
মোঃ মু জি বু র র হ মা ন
কোন জাতি যদি নিজেদের সংকট নিরসনের সহজ পথ খুঁজে না পায়, তাহলে বুঝে নিতে হবে সে জাতির শিক্ষার মধ্যে সমস্যা রয়েছে। দীর্ঘদিন যদি কোন দেশে বিশেষ কোন সমস্যা বিরাজ করে, তাহলেও ধরে নিতে হবে সমস্যাটা শিক্ষার মধ্যেই নিহিত। কারণ শিক্ষাই তো একমাত্র শক্তি, যার মাধ্যমে সাধারণ থেকে জটিল ও জটিলতর সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলো কিন্তু জাতীয় সংকটকালে শিক্ষার শক্তি প্রয়োগ করে সেগুলোর সমাধান খুঁজে বের করছে ঠিকই। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্নতর পরিস্থিতি। এখানে এখন পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানে শিক্ষা বোধ করি তেমন কোন কাজে আসছে না। বাস্তব অবস্থা দেখে মনে হয়, এ দেশে শিক্ষা নিজেই যেন ধ্বংসের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে স্থবির হয়ে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থায় গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের পত্রপত্রিকাগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বহু লেখা, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করে যাচ্ছে নিয়মিত। দেশের বিশিষ্টজনরাও গুরুত্ব দিচ্ছেন শিক্ষাকে রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে রাখার জন্য। পরীক্ষা চলাকালে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি না দেয়ার জন্যও আহ্বান জানানো হয়েছিল বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি।
দেশের ছাত্রছাত্রীরা যদি নিরাপদ ও উন্নত পরিবেশে সুশিক্ষা লাভের সুযোগ না পায়, তাহলেও সে জাতির দুর্ভোগের শেষ থাকে না। সুনাগরিক তৈরি করা জাতীয় শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও জাতীয়ভাবে তা অর্জনে বিঘ্ন ঘটলে এক সময় রাষ্ট্রকে তার চড়া মাশুল দিতে হয়। ধারণা করি, আমাদের দেশে শিক্ষার অন্তর্নিহিত শক্তি হয়তো এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে সেটা আর রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এমনকি প্রচলিত শিক্ষা পারছে না নাগরিক সমস্যার সমাধান করতে। কারণ দীর্ঘদিনেও যখন রাজনৈতিক অঙ্গনে একই ধরনের সহিংস পরিস্থিতি বিরাজ করতে দেখা যায়, তখন আমরা কী করে বলব আমাদের মধ্যে সুশিক্ষার ঘাটতি নেই? বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমাদের সন্তানরা নিরাপদে শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবে কিনা সেটাই আমাদের ভাবনার মূল বিষয়।
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের উত্তপ্ত পরিস্থিতির প্রভাব সঞ্চারিত হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে। শুধু নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ বিপর্যস্ত। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এ ধরনের অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না সহসা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন কর্মসূচির কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে পড়ালেখা, বন্ধ থাকছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পিছিয়ে যাচ্ছে নির্ধারিত পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বেড়ে যাচ্ছে কোর্সের ব্যাপ্তি, দেখা দিচ্ছে সেশনজট, আর দুশ্চিন্তা-দুর্ভোগ বাড়ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। আমাদের আশংকা, হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্কুলেও এক সময় সৃষ্টি হবে সেশনজটের। কারণ স্কুলগুলোয় এখন দিনের পর দিন ক্লাস হচ্ছে না। হরতাল ও রাজনৈতিক কর্মসূচির ফাঁদে পড়ে লাগাতার বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। হরতালের ফাঁকে ফাঁকে যে কয়দিন স্কুল খোলা থাকে (হরতালের মধ্যে কিছু স্কুল খোলা থাকলেও ক্লাস হয় না) সেসব দিনেও শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যেতে চায় না। স্কুলে পড়ালেখা না হওয়ায় বইয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংযোগ কমে গেছে। ফলে তারা অলস সময় কাটাচ্ছে। বাস্তবত, এখন শিক্ষকদেরও তেমন কোন কাজ নেই। অথচ শিক্ষাবর্ষের প্রায় অর্ধেক সময় পার হতে চলল। স্কুলগুলোয় নিয়মিত পড়ালেখা আরম্ভই হয়নি। শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীনে পাবলিক পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে বারবার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত বিভিন্ন পরীক্ষাও পিছিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে চলমান এইচএসসির দুটো বিষয়ের পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। আশংকা রয়েছে, রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলোও বিঘ্নিত হতে পারে। একের পর এক হরতাল ও সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন থেকে যায়, এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে শিক্ষার অন্তর্নিহিত শক্তি আমাদের মুক্তি দিতে পারছে না কেন?
শিক্ষা কার্যক্রম সরকার পরিচালনা করলেও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। এমনকি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে নির্বিঘ্নে যাতায়াতের বিষয়টিও কাউকে ভাবিয়ে তুলতে পারছে বলে মনে হয় না। গত ১২ এপ্রিল দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা। ওই দিন শুধু টাঙ্গাইল জেলায় কয়েক হাজার প্রার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, পরীক্ষার আগের দিন বৃহস্পতিবার টানা কয়েক দিনের হরতাল শেষ হওয়ার পর হাজার হাজার গাড়ি একসঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ে। তখন রাত হলেও মানুষ হয়ে পড়ে কর্মব্যস্ত। ফলে দেশের অনেক জায়গায় দেখা দেয় তীব্র যানজট। অনেক স্থানে কিছু গাড়ি বিকল হয়ে পড়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কিছু চালকের আইন না মেনে গাড়ি চালানোর প্রবণতা। টাঙ্গাইলের মহাসড়কেও বৃহস্পতিবার রাত থেকেই যানজট দেখা দেয়। পরীক্ষার দিন যানজট আরও বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পরীক্ষার্থীরা এক সময় গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেঁটেই পরীক্ষার কেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা দেন। আর যাদের পরীক্ষা কেন্দ্র দূরে ছিল তাদের বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় উপস্থিত হতে পারেননি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা শুধু যাতায়াতের দুর্ভোগের কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন না তাদের বিষয়টি কীভাবে দেখা হবে? তারা যে ক্ষতির মুখোমুখি হলেন সেটা পূরণ হবে কীভাবে? মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকেই বা তাদের মুক্তি দেবে কে? পরীক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের ব্যবস্থা কেন করা গেল না? এর জন্য দায়ী কে?
যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে যদি দেশজুড়ে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, বিপর্যস্ত হয় শিক্ষা কার্যক্রম, বিঘ্নের মুখে পড়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখা, তাহলে সাধারণ মানুষের করণীয় তেমন কিছুই থাকে না। আমাদের উচিত ছিল, শিক্ষার্থীরা যাতে নির্বঘ্নে পড়ালেখা করতে পারে, পরীক্ষার্থীরা যাতে নিরাপদে এবং সময়মতো পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে পারে তার সুব্যবস্থা করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিক সংকটের চাপে পড়ে পড়ালেখাবিমুখ হয়ে পড়ছে, পরীক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে নিজ দায়িত্বে পরীক্ষার কেন্দ্রে যাচ্ছে; যদিও অনেক পরীক্ষার্থী পরীক্ষার কেন্দ্রেও যেতে পারছেন না। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা করছি কী?
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে অনেক স্থানে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের প্রাণহানিরও খবর পাওয়া গেছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা যেমন উদ্বিগ্ন হই, তেমনি শিক্ষার্থীরাও আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এমনকি পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচারিত সংঘাত ও সংঘর্ষের ছবি দেখে শিশুদের মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার প্রবল আশংকা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া আমাদের কারও জন্যই শুভ নয়।
শেষ করার আগে বলতে হয়, শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অনেক সাফল্যজনক অর্জন রয়েছে, যেগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ২০১৩ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তরে নবপ্রবর্তিত শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। কারণ যে শিক্ষাক্রমের প্রয়োগ ভালোভাবে আরম্ভই হতে পারল না, সেটার কার্যকারিতা যাচাই করা হবে কীভাবে? শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যদি অলস সময় কাটায় তাহলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে শিক্ষাক্রম আধুনিকায়ন করে কার্যত আমাদের কী লাভ হল?
মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com

Saturday, April 6, 2013

শিক্ষাব্যবস্থা থাকুক রাজনৈতিক কর্মসূচিমুক্ত



ঢাকা, শনিবার, এপ্রিল ৬, ২০১৩, চৈত্র ২৩, ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
শিক্ষাব্যবস্থা থাকুক রাজনৈতিক কর্মসূচিমুক্ত

মো. মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন কিছু অদ্ভুত ও অভাবনীয় ঘটনা ঘটে চলেছে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এক কথায় চলমান পরিস্থিতি শিক্ষার জন্য সৃষ্টি করেছে চরম সংকটজনক অধ্যায়। রাজনীতির মাঠে কী ঘটবে, রাজনৈতিক দলগুলো কী কী কর্মসূচি দেবে ও পালন করবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও আলাপ-আলোচনার অধিকার রাজনীতিকদের হাতে থাকলেও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনও রয়েছে। আমরা দেখছি, এ বছরের শুরু থেকেই দেশে যে ধরনের অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এক রকম ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতা শিক্ষাকে গভীর সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দেশের উন্নয়নের বিষয়টি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করলেও শিক্ষাকে উপেক্ষা করে কোনো দেশই উন্নতি করতে পারে না। যেকোনো ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলে শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন রাখতে হবে নির্বিঘ্ন। বর্তমানে যারা শিক্ষার্থী, একসময় তাদের হাতেই অর্পিত হবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে হলেও শিক্ষার্থীদের জন্য সুশিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা জরুরি। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা কি নিজেদের তেমনভাবে উপযুক্ত শিক্ষার্থী ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছে? বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন এখন অনেক দিক থেকে অনিরাপদ ও বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে। এবার যেন শুরু হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিস্ময়ের ব্যাপার, স্কুল শিক্ষাবর্ষের তিন মাস কেটে গেলেও এখনো কোনো স্কুলেই নিয়মিত পড়ালেখা শুরু হয়নি বলে গণমাধ্যমে খবর রয়েছে। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক হিসাবে দেখানো হয়েছে, গত তিন মাসে মাত্র ২০-২৫ দিন স্কুল খোলা ছিল। তাও ক্লাস হয়েছে ঢিলেঢালাভাবে। এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থাকায় স্বাভাবিকভাবেই অনেক স্কুল বন্ধ ছিল।
অন্যদিকে দেখা যায়, রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে বহু স্কুল থাকছে দিনের পর দিন বন্ধ। শুধু সরকারি নিয়ম রক্ষার জন্য যেসব স্কুল খোলা থাকছে, সেখানেও ক্লাস হচ্ছে না নিয়মিত; শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতার কারণে স্কুলে আসতে পারছে না। অনেক শিক্ষক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে আসছেন শুধু চাকরি বাঁচানোর জন্য। অনিয়মিতভাবে স্কুলে আসার কারণে শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলবিমুখ হয়ে পড়েছে অনেকটাই। এমনকি নিষিদ্ধ কোচিং সেন্টারগুলোয়ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। তারা পড়ালেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শিশুদের শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠান কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীরাও হরতালসহ অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে ছোটবেলা থেকেই। বহু কিন্ডারগার্টেন স্কুল এখন সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয়ও খোলা রাখতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ফলে ছুটির দিনে কেন স্কুল খোলা থাকছে এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়া যাচ্ছে না ছোট শিশুদের। শিশুরা জানে ও বিশ্বাস করে, ছুটির দিন মানেই আনন্দ-উল্লাস আর ঘুরে বেড়ানো। অথচ তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে বাস্তব সত্যের দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব কীভাবে নিরসন করা যাবে? এসব দিক এখন শিশুদের মনে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। এগুলো উদ্বেগের বিষয়।
সরকার ২০১৩ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তরে প্রবর্তন করেছে নতুন শিক্ষাক্রম। এ শিক্ষাক্রম সম্পর্কে শিক্ষকদের ধারণাও অপেক্ষাকৃত কম থাকায় নবপ্রবর্তিত শিক্ষাক্রমের আওতায় কীভাবে নতুন নতুন বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের পড়াতে হবে তা শিক্ষকদের জানা জরুরি ছিল। কারণ যে শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে পাঠদান করবেন, তারা যদি না জানেন, কীভাবে পড়াতে হবে তাহলে শিক্ষার্থীদের শেখাবেন কী? নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা অর্জনে দরকার ছিল স্কুলগুলো নিয়মিতভাবে খোলা রাখা। অথচ স্কুলকার্যক্রম বিঘ্নের মুখে পড়ায় শিক্ষকরাও নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে রয়েছেন অন্ধকারে। দেশজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে স্কুলে শিক্ষাদান কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় নতুন শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নও এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় আমরা কীভাবে আশা করব আমাদের শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন ঘটবে? দেশে যতই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করুক না কেন, একসময় শিক্ষাবর্ষ শেষ হবে এবং শিক্ষার্থীরাও স্কুলের নির্ধারিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে আর পাসও করবে; কিন্তু পরীক্ষায় পাস করলেই কি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হয়?
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বিঘ্ন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। হরতাল থাকায় শিক্ষা বোর্ডগুলো এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে অনেকবার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও নির্ধারিত পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছে। এসব নিয়ে অভিভাবকরা ছিলেন উদ্বেগ। পরীক্ষার্থীরা তো চরম দুশ্চিন্তা নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করেছে। পরীক্ষার রুটিন অনুযায়ী তারা যে বিষয়ের প্রস্তুতি নিয়েছে, পরে দেখা গেছে ওই বিষয়ের পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে তাদের প্রস্তুতিতে ঘটানো হয়েছে বিঘ্ন, তারা মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতায় ভুগেছে। শিক্ষার্থীদের এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য দায়ী কে? কেন শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা যাচ্ছে না?
এবার এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। পরীক্ষা ঠিকমতো আরম্ভ হতে না হতেই শুরু হয়েছে সংঘাতময় পরিস্থিতির। এপ্রিলজুড়েই বিভিন্ন ধরনের পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচির খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে চলমান এইচএসসি পরীক্ষাটিও যে বিঘ্নের মুখে পড়বে— এমন আশঙ্কা অমূলক নয় মোটেই। এ নিয়ে পরীক্ষার্থীরা চরম উদ্বেগ ও উকণ্ঠায় রয়েছে। অভিভাবকরাও অতিবাহিত করছেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সময়।
এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার রুটিন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা শেষ করতে পারবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়। প্রশ্ন জাগে, পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে নাকি নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে কি হবে না— সেটা নিয়ে চিন্তান্বিত থাকবে? এ ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে তারা ভালোভাবে পরীক্ষা দেবে কীভাবে? এখন দেখা যায়, দেশে বিরাজিত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের শিক্ষার জন্য চরম বেদনাদায়ক ও উদ্বেগজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুঃখের ব্যাপার, এসব দিক থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত।
উন্নত দেশের সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য, আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রভাবমুক্ত রাখতে পারছি না, তারা পারছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা নেতিবাচক রাজনীতির চর্চা দেখছে শিক্ষার্থী অবস্থায়ই। তারা সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের তৈরি করার সুযোগ পাচ্ছে না। উন্নত দেশে সংঘাতময় রাজনীতির মহড়া দেখা যায় না সচরাচর। অথচ আমাদের শিক্ষার্থীরা দেখছে, রাজনীতির নামে রাজপথে চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাংচুর, সংঘাত ও সংঘর্ষ। দেখা যায়, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়ে হামলে পড়ে প্রতিপক্ষের ওপর। এ অবস্থায় ভূলুণ্ঠিত হয় মানবিক গুণাবলি। এসব সুশিক্ষার লক্ষণ নয় কিছুতেই। প্রশ্ন হলো, এখন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কী করবে?
লেখক : সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com