Thursday, May 16, 2013

শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি : আরও করণীয় আছে

মে ১৬, ২০১৩, বৃহস্পতিবার : জ্যৈষ্ঠ ২, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি : আরও করণীয় আছে
মোঃ মু জি বু র র হ মা ন
গত কয়েক বছরের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে গভীরভাবে। এখন গ্রামগঞ্জেও দেখা যায় রঙিন টেলিভিশন ও ডিশ অ্যান্টেনার ছড়াছড়ি। মানুষের হাতে দেখা যায় মোবাইল ফোন, অনেক জায়গায় কম্পিউটারও ব্যবহার করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষও এখন বিভিন্ন ধরনের সেবা পেতে পারছেন সহজে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে নাগরিকরা এখন ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসাবিষয়ক তথ্য, চাকরির খবর সংগ্রহসহ নানা রকমের জরুরি তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থের লেনদেনও হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এছাড়া গ্রামের মানুষের কাছে প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে সরকারিভাবে দেশের বিভিন্ন ইউনিয়নে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (ইউআইএসসি)। এটি ইউনিয়নভিত্তিক একটি তথ্যসেবা কেন্দ্র। এর উদ্দেশ্য হল, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের হাতের নাগালে তথ্যসেবা পৌঁছে দেয়া। এসব তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে ই-মেইল আদান-প্রদানসহ দরকারি কাজ করতে পারছেন অনেকেই। এক কথায় বলা যায়, তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে গ্রামের মানুষেরও জীবনযাত্রা হয়েছে আরও সহজ ও আনন্দময়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তারা যে শুধু নিজেদের দৈনন্দিন যোগাযোগের প্রয়োজনই মেটাতে পারছেন তা নয়, এর মাধ্যমে বিনোদনের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষা ক্ষেত্রেও আরম্ভ হয়েছে। সরকার স্কুলগুলোয় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে শ্রেণীকক্ষে পঠন-পাঠন কার্যক্রমকে শিক্ষার্থীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় ও সহজ করে তুলে ধরার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে হাজার হাজার স্কুলে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন দরকারি উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব উপকরণের মধ্যে রয়েছে ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযুক্তির জন্য মডেম, পেনড্রাইভ, স্পিকার ইত্যাদি। যেসব স্কুলে তথ্যপ্রযুক্তির এসব দরকারি সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে, সেসব স্কুলের বাছাই করা শিক্ষকদের আগেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রশিক্ষণে শিক্ষকদের শেখানো হয় কীভাবে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও তা শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের সামনে ব্যবহার করতে হবে। তবে শিক্ষকরা যে শুধু ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করে শ্রেণীকক্ষে ব্যবহার করবেন, সেটাই এ প্রশিক্ষণের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। বরং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় তাদের সবাইকে শিক্ষাবিষয়ক একটি নির্দিষ্ট সাইটের (www.ictinedubd.ning.com) সদস্য করা হয়ে থাকে এবং শিক্ষকদের তৈরিকৃত ডিজিটাল কনটেন্টগুলো ওই সাইটে আপলোড করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যাতে দেশের অন্য শিক্ষকরা এগুলো প্রয়োজনের সময় ডাউনলোড করে নিজেদের ক্লাসে ব্যবহার করতে পারেন। এভাবেই শিক্ষাবিষয়ক ওই সাইটটি সমৃদ্ধ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইতিমধ্যে ওই সাইটে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন বিষয়ের কয়েক হাজার কনটেন্ট আপলোড করা হয়েছে। জাতীয় ই-তথ্য কোষে বাছাই করা চারশ’রও বেশি ডিজিটাল কনটেন্ট আপলোড করা আছে। এসব উদ্যোগ শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে।
এর বাইরে দেখা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে মাঠপর্যায়ে শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা অনেক সহজ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আগে যেখানে শিক্ষকদের নিয়োগ ও বদলির আদেশ প্রাপ্তির জন্য ডাক যোগাযোগের ওপর নির্ভর করতে হতো, এখন সেখানে এসব আদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয় আদেশ জারির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। আর সংশি¬ষ্ট শিক্ষকরা যে কোন সময় ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে নিজেদের প্রয়োজনীয় আদেশের কপি সংগ্রহ করতে পারছেন স্বল্পতম সময়ে। এমনকি বিদেশে প্রশিক্ষণ, বৈদেশিক বৃত্তির খবর, বেতন-ভাতা সংক্রান্ত আদেশ, বিদেশ ভ্রমণের অনুমতির আদেশ, ছুটি-সংক্রান্ত আদেশ, স্কুলে নতুন শাখা খোলা, পাঠদানের অনুমতি ইত্যাদি বিষয়েও তথ্য পাওয়া যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে আবেদন করা যায় অনলাইনে। এমনকি ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলও এখন জানা যাচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এ ধরনের সহজ যোগাযোগের বিষয়টি কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে কল্পনা করা যায়নি।
দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলো ভর্তির তথ্যসহ রেজিস্ট্রেশন, পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের তথ্য, পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা, ফলাফল প্রকাশ, উপবৃত্তির খবর ইত্যাদি অবহিত করার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। ফলে শিক্ষার্থীসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবক ও অন্য যে কেউ ইন্টারনেট ব্যবহার করে বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা সম্পর্কিত দরকারি তথ্য পেতে পারছেন।
শিক্ষা ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের ব্যবহার আরম্ভ হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার ফলাফল জানতে পারছে সহজে। আগে যেখানে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পরদিন পত্রপত্রিকায় প্রকাশের অপেক্ষায় থাকতে হতো; কিংবা পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে ফলাফল জানতে হতো, বর্তমানে ওই পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। এখন পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তা জানা যাচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
অন্যদিকে দেখা যায়, শিক্ষক প্রশিক্ষণে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইট খুলে দিয়েছে। এসব সাইটে কলেজভিত্তিক প্রশিক্ষণার্থী ও প্রশিক্ষকদের তথ্যসহ প্রশিক্ষণ বিষয়ক দরকারি তথ্য জানার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোয় সরকারি ব্যবস্থাপনায় ওয়েবসাইট খুলে দেয়া হলেও অধিকাংশ কলেজের সাইটই আপডেট করা হয় না নিয়মিত। অনেক কলেজের সাইটে প্রবেশ করে দেখা গেছে, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তথ্য আপডেট করা হয় না। কোন কোন কলেজের সাইটে প্রায় দুই বছরেরও বেশি আগের তথ্য রয়েছে। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, সরকারি টাকায় ওয়েবসাইট খুলে দেয়া হলেও সেগুলো নিয়মিত আপডেট না করায় কার্যত টাকাগুলো জলে যাচ্ছে।
শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ও চাকরি-সংক্রান্ত তথ্যাবলী সংরক্ষণ করার জন্য মন্ত্রণালয়ে চালু করা হয়েছে পার্সোনাল ডাটাশিট (পিডিএস)। এই পিডিএস তৈরি করতে গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের কাছ থেকে তাদের তথ্যসংবলিত হার্ড কপি সংগ্রহ করে সফট কপিতে পরিণত করে থাকে। তবে বর্তমানে যে পদ্ধতিতে এই পিডিএস আপডেট করা হয় তা বেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। বিকল্প হিসেবে পাসওয়ার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষককে দিয়ে যদি নিজের পিডিএস আপডেট করানো যেত, তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে পিডিএস সংরক্ষণের বিষয়টি আরও সহজ ও সুবিধাজনক হতো। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভেবে দেখতে পারে।
এখানে শিক্ষা ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের যেসব দিকের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো সরকারি প্রচেষ্টার অংশ হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক দিকটি তেমন গুরুত্ব পায়নি। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের বিপুল সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সংরক্ষণ, অর্থ আদায় ও ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ, ডিজিটাল সিলেবাস প্রণয়ন, পাঠদান কার্যক্রম মনিটরিং, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারিভাবেও বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার তৈরি করে তা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি সরকারিভাবেও স্কুল-সফটওয়্যার তৈরি করে দেয়া হয়, তাহলেও সেগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহার সম্ভব হবে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃথক পৃথক চাহিদা অনুযায়ী সফটওয়্যার তৈরি করে স্কুলগুলোয় ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপক বাণিজ্যিক সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষার দেশীয় বাজারসহ আন্তর্জাতিক অনেক বাজারেও বাংলাদেশের সফটওয়্যার নির্মাতাদের প্রবেশ করা সম্ভব হবে। শেষ করার আগে বলব, স্কুল শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ইতিমধ্যে বাংলাদেশ যেসব ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করেছে, সেগুলো নিয়েই প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রবেশ সম্ভব। তবে এজন্য সরকারিভাবে নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ।
মোঃ মুজিবুর রহমান : সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক


mujibur29@gmail.com