Wednesday, March 6, 2013

সংকটে শিক্ষা

মার্চ ০৬, ২০১৩, বুধবার : ফাল্গুন ২২, ১৪১৯
(বাতায়ন)
সংকটে শিক্ষা
মোঃ মু জি বু র র হ মা ন
এসএসসি পরীক্ষার মতো একটি বড় পাবলিক পরীক্ষা যেভাবে বারবার পেছানো হচ্ছে, তা কোন উন্নত দেশে হয় কি-না সন্দেহ রয়েছে। অথচ আমাদের দেশে এমনটি যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যদিও পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়াকে কোনভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা বলা যায় না। পরীক্ষা পরিচালনা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেই কেবল তা পিছিয়ে দিতে হয়। বাস্তবে এখন হচ্ছেও তাই। বারবার পরীক্ষা পিছিয়ে দিলে পরীক্ষার্থীদের ওপর যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, সে দিকটিও থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। এখন দেখা যাচ্ছে, চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা দেখছি, এ পরীক্ষাটি শুরু হওয়ার পর এরই মধ্যে কয়েকবার পেছাতে হয়েছে। এ অবস্থায় বাকি পরীক্ষাগুলোও যথাসময়ে শেষ হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় ও অনিশ্চয়তা রয়েছে। অন্যদিকে পরীক্ষার্থীরা রয়েছে সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে। তারা পরীক্ষা নিয়ে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের অনেকেই হয়ে পড়েছে হতাশাগ্রস্ত। একই সঙ্গে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরাও। পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময়সীমাও পিছিয়ে যাবে; ফলাফল প্রকাশেও ঘটতে পারে বিলম্ব। এমনকি পরীক্ষার ফলাফলে এসব ঘটনার প্রভাব পড়তে পারে।
কেন পরীক্ষা পেছাতে হচ্ছে, তা সবারই জানা। ঘন ঘন পরীক্ষা পেছানোর ফলে পরীক্ষার্থীরা যে চরম অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে, তা থেকে কেউই তাদের মুক্তি দিতে পারছে না। শুধু যে শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা পেছাতে হচ্ছে, তা নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত অনার্স কোর্সের পরীক্ষাও পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া স্কুল-কলেজের পড়ালেখাও বিঘ্নিত হচ্ছে। চলমান এসএসসি ও অনার্সের এতগুলো পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিবর্তিত দিনক্ষণের হিসাব রাখাটাই এখন পরীক্ষার্থীদের কাছে কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন পরীক্ষা কবে হবে, পরীক্ষার্থীরা সে হিসাব রাখবে নাকি ভালো মনে পড়ালেখা করবে?
এদিকে ১ এপ্রিল থেকে আরম্ভ হতে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। কারণ দেশে বর্তমানে যে ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে এইচএসসি পরীক্ষা পরিচালনায়ও বিঘ্ন ঘটবে এবং একসময় হয়তো সেটিও পিছিয়ে দেয়া ছাড়া কর্তৃপক্ষের করণীয় কিছুই থাকবে না। যারা এইচএসসি পরীক্ষার্থী তারা পরীক্ষার নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে কি-না, এটাও নিশ্চিত নয়। ফলে পরীক্ষা শুরুর আগেই পরীক্ষার্থীরা উদ্বেগের মধ্যে দিন পার করছে। এভাবে কোন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হতে পারে না। একটি পাবলিক পরীক্ষা কয়েকবার পিছিয়ে দেয়াই প্রমাণ করে নির্বিঘ্নে পরীক্ষা নেয়ার মতো পরিবেশ নেই। জাতীয় স্বার্থেই এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে পরীক্ষার্থীসহ শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেয়া জরুরি।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে যে ধরনের কর্মসূচিই পালন করা হোক, তা যাতে শিক্ষা কার্যক্রমে বিঘ্ন না ঘটায় সেদিকটি বিবেচনায় রাখা জরুরি। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে যদি অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের ওপর; ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের দেশে শিক্ষার ক্ষতি তাৎক্ষণিকভাবে নির্ণয় করা হয় না বলেই হয়তো এ নিয়ে ব্যাপকভাবে তেমন উদ্বেগ দেখা যায় না। অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে প্রায় সবাই উদ্বিগ্ন থাকেন বলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে প্রতিদিন দেশে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয় তার হিসাব করে বের করা হয় নিয়মিত। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায় না সহজে। অথচ শিক্ষাখাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশ কয়েক দশকের জন্য ছিটকে পড়বে উন্নয়নের সিঁড়ি থেকে; যা পূরণ করা কোন জাতির জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার। শিক্ষা সব উন্নয়নের মূল নিয়ামক হলেও বাংলাদেশে শিক্ষাখাতই এখন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে শিক্ষার ক্ষতি ধরা না পড়লেও প্রকৃতপক্ষে এর ক্ষতি সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক। এখানে এখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই নিরুদ্বিগ্ন মনে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীরা এক ধরনের আতংকের মধ্যে দিন পার করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের পড়ালেখায় ঘটছে বিঘ্ন। আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের যারা নিজস্ব কলেজে মডেল টেস্টসহ অন্যান্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে তারাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকছে। কেউ কেউ পরীক্ষার সময় শেষ হওয়ার আগেই হল থেকে বের হয়ে আসছে দ্রুত বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। এ অবস্থায় কি তাদের পক্ষে ভালোভাবে পড়ালেখা করা সম্ভব? উদ্বেগের মধ্যে থেকে তারা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিই বা নেবে কিভাবে? উন্নত শিক্ষার কথা না হয় বাদই দিলাম, অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও কি সম্ভব? সম্ভব কি শিক্ষার প্রত্যাশিত মান ধরে রাখা? প্রশ্ন জাগে, আমাদের শিক্ষা নিয়ে আজ আমরা কোন পথে?
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস স্কুলগুলোয় পুরোদমে পড়ালেখা করার উপযুক্ত সময়। অথচ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। কখনও শ্রেণীকক্ষে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকলেও শিক্ষকরা পাঠদানে মন বসাতে পারেন না। কারণ তারাও থাকেন একরকম আতংকের মধ্যে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সৃষ্ট অস্থিরতার কারণে আমাদের শিক্ষা এখন সংকটের মুখে পড়েছে।
শিক্ষা কার্যক্রমকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখতে পারলে দেশ শিক্ষাখাতসহ অন্যসব ক্ষেত্রেই ব্যাপক উন্নতি করতে পার, সন্দেহ নেই। প্রাজ্ঞ পাঠকরা জানেন, উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সব সময় রাজনৈতিক কর্মসূচিমুক্ত থাকে। সেখানে রাজনৈতিক কারণে পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটানোর কোন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে সেসব দেশে স্বাভাবিকভাবেই পড়ালেখার মান হয়ে থাকে উন্নত। অথচ বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটিয়ে আমরা যে কখনোই উন্নত দেশে পরিণত হতে পারব না- এ সত্যটি মনে রাখতে হবে সবাইকে। আজ বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে শিক্ষায় যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে দ্রুত।
মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com